অভিমানী প্রিয়ার মান ভাঙ্গানো জন্য মাইকেল মধুসূদন দত্তের প্রত্যেকটি লেখাই এক একটি চিঠি


মো: আব্দুস সালাম,বড়াইগ্রাম,নাটোর
মাইকেল মধুসূদন দত্তের সাহিত্য সাধনার সুবিশাল অধ্যায়ের সমস্ত রচনা- কাব্য, পত্র কাব্য, মহাকাব্য, নাটক,প্রহসন, চতুর্দশপদী কবিতাবলী ইত্যাদি প্রত্যেকটা রচনাকে যদি অভিমানী প্রিয়ার মান ভাঙ্গানো এক একটা চিঠি বলি তাহলেও হয়তো অত্যুক্তি হবেনা।
গ্রামের পাঠশালায় লেখা- পড়া শেষ করে মাত্র ১৩ বছর বয়সে কলিকাতায় যান। কিছুদিন পর প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। মধুসূদন দত্ত মাদ্রাজে লেখা-পড়া করতে গিয়ে প্রথম যৌবনে  রেবেকা ম্যাকটিভিস নামে এক ইংরেজ যুবতিকে ভাল বেসে বিয়ে করেন। মাইকেল মধুসূদন দত্ত তাঁর সাহিত্য কর্মে বিশেষ করে ইংরেজ কবি বায়রনের সাহিত্য কর্মে এবং পাশ্চাত্য সাহিত্যের প্রতি অনুপ্রণিত ও আকৃষ্ট হয়ে ইংরেজি ভাষায় সাহিত্য রচনায় মনোনিবেশ করেন। তিনি ইংরেজি ভাষার প্রতি গভীর ভাবে আকৃষ্ট হন এবং মাতৃভাষা বাংলাকে ঘৃণা করতে শুরু করেন। চারি দিকে আলোচনার ঝড় উঠে। কবি আব্দুল হাকিম তো লিখেই বসলেন-"যে সব বঙ্গেত জন্মে হিংসে বঙ্গবাণী,সে সব কাহার জন্ম  নির্ণয় ন জানি"। মাইকেল মধুসূদন দত্ত দি ক্যাপটিভ লেডি এবং প্যারাডাইস লস্ট লিখে ইংরেজি সাহিত্যাঙ্গনে বেশ সুনাম অর্জন করলেন  কিন্তু তাঁর মাতৃভাষা ইংরেজি না হওয়ায় সমাদৃত হতে পারেননি। অবশেষে বেথুনের পরামর্শে ১৮৫৬ সালে  কলিকাতায় ফিরে এসে মাতৃভাষায় সাহিত্য সাধনায় মনোনিবেশ করেন এবং অভিমানি প্রিয়ার মান ভাঙ্গানোর জন্য আমৃত্যু সাহিত্যের পাতায় প্রেমের  চিঠি লিখতে শুরু করেন।
মাইকেল মধুসূদন দত্ত ১৮২৪ সালে ২৫ জানুয়ারি বাংলাদেশের যশোহর জেলার কেশবপুর উপজেলার সাগরদাঁড়ি গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত হিন্দু কায়স্থ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন এবং মাত্র ৪৯ বছর বয়সে ১৮৭৩ সালে ২৯ জুন আলীপুর জেনারেল হাসপাতালে কপর্দকহীন অবস্থায় মারাযান।
বিশ্বাস্থতা অর্জন  অত্যন্ত কঠিন কাজ না হলেও সহজ নয়। বিশেষ করে প্রথমবার বিশ্বস্থতা অর্জন করা যতটা কঠিন, প্রতিষ্ঠিত  বিশ্বাস  ভাঙ্গা তার চেয়েও কঠিন। বিশ্বাস একবার ভেঙ্গে গেলে  সেটা প্রতিষ্ঠিত করা তার চেয়ে আরও ঢের কঠিন, অত্যন্ত দুরহ। প্রবাদ আছে সব কিছু ভাঙ্গলে জোড়া লাগে কিন্তু মন ভাঙ্গলে কখনো জোড়া লাগেনা। যদি জোড়া লাগেও অবস্থাটা এমন হয়- বজ্র আটুনি ফসকা গেরো। তার পরও কথা থেকে যায়- কাজী নজরুল ইসলাম লিখেছেন- এত ষঠতা এত যে ব্যথা তবু যেন তা মধুতে মাখা। এই যা ভরসা।
মাইকেল মধুসূদন দত্ত যুগোত্তীর্ণ মহাকবি। অনন্য ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন নবজাগরণের বিপ্লবী চেতনার বিদ্রোহী কবি বললেও অত্যুক্তি হবেনা,মধ্যযুগের সাহিত্যের একমাত্র উপজীব্য ছিল দেব-দেবতা। সাধারণ মানুষের জীবন কর্ম সাহিত্যের পাতায় স্থান পেতনা। মানুষের সুখ, দুঃখ, হাসি- কান্না, আনন্দ-বেদনা, চাওয়া-পাওয়া-না পাওয়া,আশা এষনার কোন স্থান ছিলনা। মাইকেল মধুসূদন দত্ত মা ও মাতৃভ'মির প্রতি অবজ্ঞা করে বিদেশি ভাষা চর্চা করে সেখান থেকে ইংরেজি সাহিত্যভান্ডার মন্থন করে এনে বাংলা ভাষাকে সমৃদ্ধ করেছেন। তাঁর লেখায় দেশীয় উপকরণে রক্তমাংসে গড়া মানুষের জয়গানে মুখরিত হল বাংলা সহিত্য সম্ভার। রচনা করলেন নাটক- শর্মিষ্ঠা ১৮৫৯,পদ্মাবতী,কৃষ্ণ কুমারী-১৮৬১, প্রহসন-একেই কি বলে সভ্যতা এবং বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ-১৮৬০। কাব্য-তিলোত্তমাসম্ভব-১৮৬০,ব্রজাঙ্গনা-১৮৬১,বীরাঙ্গনা-১৮৬২ মহাকাব্য-মেঘনাদ বধ-১৮৬১, হেক্টর বধ,চতুর্দশপদী কবিতা-১৮৬৬ ইত্যাদি।
একজন ভিক্ষুক কোন বাড়ি গিয়ে যখন তার প্রশংসা করে কিংবা তার আত্মীয় স্বজনের খোঁজ খবর দিয়ে কুশল বিনিময় করে তখন ঐ বাড়িওয়ালা তাকে ভিক্ষা না দিয়ে পারে না। কোন সন্তান যদি তার বাবা কিংবা মা এর প্রশংসা করে আদর মাখা কণ্ঠে তার কাছে কিছু প্রার্থনা করে সেও তার সন্তান কে ফিরিয়ে দিতে পারে না। বন্ধু যদি তার বান্ধবীকে বার বার প্রশংসা করে তার কাছে কিছু প্রার্থনা করে তাহলে সেও তার বন্ধু কে নিরাশ করতে পারে না। ইসলাম ধর্মের ধর্মীয় গ্রন্থ আল্ কোরআন এ ১১৪টি সুরা আছে। তার মধ্যে সুরা আল ফাতিহাকে উম্মুল কোরআন বা কোরআনের জননী বলা হয়। সেই সুরা ফাতেহার ৭টি আয়াতের প্রথম ৪টিতে আল্লাহর প্রশংসা করা হয়েছে অতঃপর শেষ ৩ আয়াতে আল্লাহর নিকট প্রার্থনা করা হয়েছে। এমনটি বলা হয়েছে সুরা ফাতিহা পাঠ করে কোন দোয়া করলে সে দোয়া কবুল হয়।
মাইকেল মধুসূদন দত্ত এর সকল সাহিত্যকর্মের একটি কবিতা "কপোতাক্ষ নদ" এর কথাই বলি । এই কবিতাটি মাইকেল মধুসূদন দত্ত এর চতুর্দশপদী কবিতাবলীর একটি কবিতা। এর প্রথম ৮ লাইনে  কপোতাক্ষ নদ তথা বাংলাদেশের রুপ,সৌন্দর্য,মাতৃদুগ্ধ,তৃষ্ণা নিবারণ ইত্যাদি গুনগান করা হয়েছে এবং পরের ৬ লাইনে তার কাছে নিরব মনের অনন্ত প্রার্থনা করেছেন। মাতৃবিদ্বেষী হওয়ার পর পুনরায় বিশ্বাস স্থাপনের আপ্রাণ চেষ্টা এবং তাঁর প্রত্যেকটি লেখাই অভিমানী প্রিয়ার মান ভাঙ্গানোর জন্য লেখা এক একটা চিঠি বললেও অত্যুক্তি বলা হবে না।
অন্তিম পর্যায়ে মাতৃভূমির প্রতি তাঁর সুগভীর ভালবাসার অবিস্মরণীয় চিহ্ন লিখে গেছেন যা তার কবরে লেখা রয়েছে-
দাঁড়াও পথিকবর, জন্ম যদি তব
বঙ্গে! তিস্ঠ ক্ষণকাল! এ সমাধি স্থলে
( জননীর কোলে শিমু লভয়ে যেমতি
বিরাম)মহীর পদে মহানিদ্রাবৃত
দত্তকুলোদ্ভব কবি শ্রীমধুসূদন!
যশোরে সাগরদাঁডি কপোতাক্ষ- তীরে
জন্মভূমি, জন্মদাতা দত্ত মহামতি
রাজনারায়ন নামে জননী জাহ্নবী ।।

Comments