Sponsored ads go below

Thursday, April 1, 2021

বছরের পর বছর পেরিয়ে গেলেও বড়াইগ্রামে এম.পি সহ ৮ বীর মুক্তিযোদ্ধা হত্যার বিচার এখনো ঝুলন্ত



মোঃ আব্দুস সালাম, নাটোর

স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী ও মুজিব শতবর্ষ উৎসাহ উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে পালিত হলেও নাটোরের বড়াইগ্রাম উপজেলায় দুর্বৃত্তদের হাতে নিহত ৮জন বীর মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের সদস্যদের ¤øান মুখে হাসি ফুটেনি। বছরের পর বছর পেরিয়ে  গেলেও হত্যাকান্ডের বিচার এখনও ঝুলন্ত। সংশ্লিষ্ট ঘাতকরা কেউবা মৃত্যুবরণ করেছে, কেউবা স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে এখনো ঘুরে বেড়াচ্ছে মহা দাপটে।
৭১'এ বাঙ্গালী চৈতন্য জাগরণের যে প্লাবন তৎকালিন পূর্ববঙ্গে ঘটেছিল, সে ঢেউ লেগেছিল নাটোর জেলার বড়াইগ্রামেও। ৭১'র ৭'ই মার্চের বঙ্গবন্ধুর বজ্রকণ্ঠের ঐতিহাসিক ভাষণে উদ্বুদ্ধ হয়ে দেশ মাতৃকাকে শত্রæ-মুক্ত করতে অস্ত্র হাতে তুলে নিয়েছিলেন তারুণ্যের ঢেউ খেলা উত্তাল যুবক, আপোষহীন শিক্ষক, বিদ্রোহী কৃষক, সংগ্রামী ছাত্র। তাদের মধ্যে কেউবা ৭১'র রনাঙ্গনে, কেউবা যুদ্ধ পরবর্তীতে স্বাধীন বাংলাদেশে অবৈধ অস্ত্রধারী দুর্বৃত্তদের হাতে অকালে নিহত হয়েছেন। উপজেলার সাবেক মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার শামসুল হক জানান, দুর্বৃত্ত কর্তৃক নিহত মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে অন্যতম হলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা এ্যাড. রফিক উদ্দিন সরকার এমপি, শাহজাহান আলী, ডাঃ আয়নুল হক, এস.এম আমজাদ আলী, ঈমান আলী মাষ্টার, আক্কাস আলী মাস্টার, রায়হান আলী, আব্দুল আজিজ। এসব হত্যাকান্ডের বিচার আজও হয়নি।  
নাটোর-৪ (গুরুদাসাপুর-বড়াইগ্রাম)আসনের সাবেক সংসদ সদস্য, মহান মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক, বীর মুক্তিযোদ্ধা এ্যাড.রফিক উদ্দিন সরকারকে বন্দুকের গুলি ও ছুরিকাঘাতে ১৯৮১ সালের ৬ এপ্রিল সোমবার রাত সাড়ে ৮ টার দিকে নৃশংসভাবে খুন করে দুর্বৃত্তরা। বীর মুক্তিযোদ্ধা রফিক উদ্দিন সরকার উপজেলার পিওভাগ গ্রামের মরহুম বছির উদ্দিন সরকারের পুত্র, তৎকালীন বড়াইগ্রাম থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও নাটোর জেলা আ'লীগের সাধরণ সম্পাদক ছিলেন। ইতিমধ্যে ৪০ টি বছর কেটে গেলও  সে হত্যাকান্ডের বিচার এখনো হয়নি।
মরহুমের ছেলে মো.আরিফ উদ্দিন সরকার জানান, ঘটনার দিন রাতে সাড়ে ৭টার দিকে নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি ক্রয় করার জন্য বাবা মোটরসাইকেল যোগে জোনাইল বাজারে যান। সেখান থেকে বাড়ি ফেরার পথে জোনাইল-পিওভাগ রাস্তার জোনাইল মুসলিম হাইস্কুল এলাকায় পৌছালে দুর্বৃত্তদের মুখোমুখি হন তিনি। ওই স্থানে রাস্তায় কলা গাছ ফেলে তৈরীকৃত ব্যারিকেডে মোটরসাইকেল থামানোর সাথে-সাথেই পাশের ঝোপ থেকে বেরিয়ে এসে দুর্বৃত্তরা উপোর্যুপরি কয়েক রাউন্ড গুলি করে। পরে ছুরিকাঘাতে তার মৃত্যু নিশ্চিত করে পালিয়ে যায়।  
১৯৭৪ সালের ৪ সেপ্টেম্বর উপজেলার লক্ষীকোল বাজারে নিজ বাড়িতে নিহত হয়েছিলেন ৭১'র মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক,বড়াইগ্রাম থানা মুজিব বাহিনীর কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা শাহজাহান আলী ও তার সহোদর বড় ভাই বীর মুক্তিযোদ্ধা ঈমান আলী। তারা ছিলেন উপজেলার নগর ইউনিয়নের মেরীগাছা গ্রামের আলহাজ্ব উমেদ আলীর পুত্র। নিহতদ্বয়ের স্বজনেরা জানান, দিনের কাজ শেষে নিজ বাড়িতে রাতে যখন তারা গভীর ঘুমে অচেতন, তখন ২৫/৩০ জন অস্ত্রধারী দুর্বৃত্ত ঘিরে ফেলে বাড়ি। কয়েক রাউন্ড গুলি ছুড়ে সেখানে সৃষ্টি করে আতঙ্ক এবং দরজা ভেঙ্গে প্রথমে ঈমান আলীর ঘরে প্রবেশ করে মাথায় গুলি করে হত্যা করে ঈমান আলীকে। পরক্ষণেই তারা কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা শাহজাহান আলীর কক্ষে প্রবেশ করে। এরমধ্যেই তিনি আত্মরক্ষার জন্য খাটের নীচে লুকিয়ে পড়েন। কিন্তু দুর্বৃত্তদের চোখ এড়াতে পারেননি তিনি। দুর্বৃত্তরা তাকে উদ্দেশ্য করে খাটের নীচে কয়েক রাউন্ড গুলি করলে গুরুতর আহত হন। এরমধ্যে মসজিদে আজানের ধ্বনি শুনা গেলে দুর্বৃত্তরা গুলি ছুড়তে- ছুঁড়তে পালিয়ে যায়। পরে স্বজনেরা বড়ভাই বীর মুক্তিযোদ্ধা ঈমান আলীকে মৃত এবং ছোট ভাই বীর মুক্তিযোদ্ধা শাহজাহান আলীকে গুরুতর অসুন্থ্য অবস্থায় উদ্ধার করে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে গরুর গাড়িতে করে  গ্রামের বাড়ি মেরীগাছাতে নিয়ে আসেন। বাড়িতে পৌছার পর-পরই বীর মুক্তিযোদ্ধা শাহজাহান আলী মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। এরপর পেরিয়ে গেল ৪৬টি বছর।

বড়াইগ্রাম থানা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি, সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান বীর মুক্তিযোদ্ধা ডাঃ আয়নুল হককে ২০০২ সালের ২৯ মার্চ শুক্রবার রাত ৮ টার দিকে নৃশংশভাবে পিটিয়ে হত্যা করে উত্তেজিত দুর্বৃত্তরা। তিনি ছিলেন মহিষভাঙ্গা গ্রামের মৃত টিনু কবিরাজের ছেলে। নিহতের স্বজনেরা জানান,তিনি যখন বনপাড়ার তৎকালীন ডাঃ আনছারুল হকের ক্লিনিকে অবস্থান করছিলেন, সেখান থেকে তাকে ধরে নিয়ে বেধড়ক মারপিট, লাঠিপেটা ও টানা-হেঁচড়া করতে-করতে বনপাড়া বাজারস্থ তার বাড়ির সামনে ফেলে রেখে যায় দুর্বৃত্তরা। পরে আশঙ্কাজনক অবস্থায় এলাকাবাসী তাকে উদ্ধার করে রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন। ১৮টি বছর অতিবাহিত হলো, হত্যাকান্ডের বিচার আজও ঝুলন্ত।  

উপজেলার দোগাছি গ্রামের মৃত দুরলভ মন্ডলের পুত্র বীর মুক্তিযোদ্ধা আক্কাস আলী মাস্টার, মেরীগাছা গ্রামের আলহাজ্ব উমেদ আলীর পুত্র রায়হান আলী, কুজাইল গ্রামের মৃত বেলাল উদ্দিন প্রামানিকের পুত্র আব্দুল আজিজকে নৃশংসভাবে হত্যা করে রাজাকাররা। নিহতদের স্বজনেরা জানান, ভারতে গিয়ে প্রশিক্ষণ চলাকালীন সময়ে ছুটি নিয়ে দেশে ফিরার পথে লালপুর উপজেলার বিলমাড়িয়া ঘাট এলাকায় পৌছলে ৭১'র ২২ জুলাই ওই এলাকার রাজাকার বাহিনী তাদের আটক করে অজানা স্থানে হত্যা করে। তাদের কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি আজও।
১৯৭৫ সালের ৩১ জুলাই পাঁচবাড়ীয়া গ্রামের তৎকালীন আম বাগানে প্লাটুন কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা এস.এম আমজাদ আলীকে হত্যা করে অস্ত্রধারী ১০/১২ জন দুর্বৃত্ত। তিনি উপজেলার থানাইখাড়া গ্রামের আজমত আলীর পুত্র। ঈশ্বরদী থেকে নিজ বাড়ী থানাইখাড়া গ্রামে আসার পথে  রাত ৯টার দিকে পাঁচবাড়ীয়া এলাকায় দুর্বৃত্তদের কবলে পড়েন। সেখানে তাকে বেধড়ক মারপিট শেষে কয়েক রাউন্ড গুলি করে তার মৃত্যু নিশ্চিত করে পালিয়ে যায় দুর্বৃত্তরা।
দেশের বিভিন্ন স্থানে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হলেও বীর মুক্তিযোদ্ধা হত্যাকারীদের বিচার আজও ঝুলন্ত রয়েছে। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী ও মুজিব শতবর্ষে নিহতদের স্বজনরা সকল নৃশংস হত্যার সুষ্ঠু বিচারের দাবী জানান। 

No comments: